বুধবার, ৩ জুলাই, ২০১৩

পারম্পরিক সংস্কৃতিময় ভ্রমণের ঝাঁপিঃ চড়িদা

মধ্যরাতে ছৌ-নাচমানুষের ভগ্ন দেহে দেবতার মুখোশ পেকাড়া-নাকড়ার শব্দে কেঁপে ওঠে দশদিকচতুর্থ প্রহরমন্দিরে মন্ত্রের মতো ধ্বনি জাগেযাগযজ্ঞে আছি মনে হয়ঝর্ণা নামে রক্তস্রোতেঅব্যক্ত ও অব্যাহতিহীন কলরোল শুধু কলরোল।- পুর্ণেন্দু পত্রী

অসামান্য সচেতন নাকউঁচু কবি পুর্ণেন্দু পত্রীও কবিতায় ছৌ শব্দটি যে কেন ব্যবহার করলেনশব্দটি কিন্তু ছো মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলে আজও দৈনন্দিনের নানান অনুষঙ্গে ছো শব্দটি অবলীলায় ব্যবহার করেন অসামান্য গ্রামীণেরা যে গ্রামটি জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যাওয়া শব্দকে জুড়েদেন নিজেদের সাংস্কৃতিক ক্ষুত পিপাসা প্রদর্শণের আঙ্গিকের সঙ্গে, সেই গ্রামটার নাম বাঙলার সাংস্কৃতিক মানচিত্রে অক্ষয় হয়ে রয়েছে তীর্থক্ষেত্রের গরীমাময় মর্যাদায়স্থানীয় ভাষায় চোড়দা, শহুরে পালিশকরা ভাযায় চড়িদা, জেলা পুরুলিয়া পারম্পরিক সংস্কৃতিময় বাঙলায় ছো মুখোশ নৃত্যের সঙ্গে চড়িদা শব্দটি একই নিশ্বাসে উচ্চারিত হয় আজও এই গ্রামেই সুত্রধর সম্প্রদায়ের মানুষ অদম্য উত্সাহে ছোএর মুখোশ তৈরি করেন আসামান্য তার কারিগরী দক্ষতা অসাধারণ তার শিল্পমূল্য বলেরাখি বাঙলার পারম্পরিক শিল্পকলার প্রযুক্তি নথিকরণ করতে থাকার সংগঠণ, কলাবতী মুদ্রা, শেষতম দুর্গা উত্সবটিতে চোড়দা গ্রাম থেকেই অসামান্য কিছু ছোএর মুখোশ পাঠাতে পেরেছিল মুম্বাইএর এক দুর্গাপুজোয় মন্ডপ সাজানোর কাজেশিল্পীরা দাম পেয়েছিলেন ভালই চোড়দা এমন একটি গ্রাম যেখানে বাঙলার অন্যতম নৃত্য আঙ্গিক, ছো নাচে পারম্পরিক পদসঞ্চার আর লালিত্যের মিশেল ঘটেছে অসামান্য গ্রামীণ শিল্প প্রজ্ঞায় বাঙলার হাজার হাজার গ্রামের মধ্যে চড়িদা সাধারণ কোনো একটি গ্রামের নাম নয়, শুধু একটি প্রশাসনিক পঞ্চায়েতও নয়, প্রত্যন্ত বাঙলার সংস্কৃতিময় জঙ্গল মহলে শুধুমাত্র একটি নাচগানের টোলাও নয়, চোড়দা এমন এক গরিমাপূর্ণ গ্রাম, যে গ্রামের অসামান্য মানুষজন অসম্ভব অহংপূর্ণ দায়িত্বে, বাঙলার হাজার হাজার বছরের শিল্প নৈপুণ্য আর সেই সংক্রান্ত প্রযুক্তিকে বুকে ধরে অটল প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন নিজস্ব গরিমায় চড়িদা ভ্রমণ তাই শুধুমাত্র হপ্তাশেষের আপিসবাবুর পকেট বাঁচিয়ে পরিবারের মন ভোলানো ডিজনিল্যান্ড ভ্রমণ নয়, শস্তাতম ছো দেখানো গাইড বই হাতে করে চোখে ঠুলি বেঁধে কানে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে ধরতক্তামারপেরেকগোছের যেমন তেমন পুরুলিয়ার পানে বেরিয়ে পড়া নয়, বল কলম হাতে যেনতেনপ্রকারেন ভ্রমণ কথা লেখা নয়, চড়িদাগ্রাম আম বাঙালি ভ্রমণার্থীদের সাংস্কৃতিক তীর্থ, যে তীর্থে মাঝেমধ্যেই তাকে মাথা ঠেকাতে যেতে হয়
হাওড়ার ট্রেনে বরাভূম স্টেশন অথবা হাওড়া থেকে পুরুলিয়া বাঙলার যে কোনও শহর থেকে পুরুলিয়া এসে বাগমুন্ডি পাহাড়গামী শকটে সত্তর কিলোমিটারের কাছাকাছি অযোধ্যা মোড়ে নামা নিজস্ব গাড়ি না থাকলে পুরুলিয়া শহর থেকে আড়াই ঘন্টারমত। গ্রামে আসতেআসতে চোখ চলে যায় দুপাশের শূন্য প্রান্তরের অসামান্য বন্য সৌন্দর্যের দিকে। গ্রামে ঢোকার পথে অযোধ্যার মোড়ে ছোট একটা বসতি। দুপা দূরেই চড়িদা গ্রাম। কলাবতী মুদ্রারই পারম্পরিক শিল্পীদের সংগঠণ বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘর অন্যতম সম্পাদক, জাতীয় শিল্পীর পুরস্কার বিজয়ী মুখোশ শিল্পী, গায়ক, নর্তক নেপাল সূত্রধরের বাড়ি চড়িদায় তিনিসহ তিন প্রজন্ম অত্যন্ত সুমধুরভাবে জড়িয়ে রয়েছেন এই কলায় চড়িদায় খুব কম ঘরই আছে যেখান থেকে এক জনও ছো শিল্পী ইউরোপ-আমেরিকায় অনুষ্ঠান করতে যাননি। নেপাল বহুবার বিদেশে গিয়েছেন মূর্তি তৈরি করতে, কর্মশালা পরিচালন করতে শুধু মুখোশ নয়, মূর্তি তৈরি করতেও তার বহু নাম, বিশ্বে বহু প্রান্তের জাদুঘরে তাঁর তৈরি মূর্তি আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে
প্রায় ৮০টি পরিবার নিয়ে এই গ্রাম। নেপালেরমতই প্রতি বাড়িতে প্রায় একই দৃশ্য। বাড়ির দালানে বসে পরিবারের বড় থেকে ছোটপ্রায় সব সদস্যই ছো নাচের মুখোশ তৈরিতে ব্যস্ত। ব্যস্ততার মধ্যেও ঘুরতে আসা ভ্রমণার্থীর নানান চালাকিময় প্রশ্নের উত্তর দেন ধৈর্য ধরে হাসিমুখেশিল্পীর অহংপূর্ণ হাসিটা ধরাথাকে ঠোঁটে শিল্পীর অহং কিন্তু আহংকার নয় অসামান্য গ্রামীণ সলজ্জতা আর বিনম্রতা তাঁদের কথায়। ঘরের ভিতর উঁকি মারলেই দুর্গা, গণেশশিব, অসুরেরমুখোশ দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে অসামান্য উজ্জ্বলতায়। আকারও বিভিন্ন ধরনের। কিনতে চাইলে কিনেও ফেল যায় ছো নাচ দেখতে চাইলে আগে থেকে যোগাযোগ করতে হয় পদ্মশ্রী খেতাব পাওয়া ছো শিল্পী গম্ভীর সিংহ মুড়ার নাম জুড়ে আছে চড়িদার সঙ্গে, নেপালও গম্ভীর সিংএর দলের শিল্পী ছিলেন। যে গুরুর হাত ধরে ছো নাচ এ গ্রামকে বিদেশে নিয়ে গিয়েছে, কথায় কথায় সেই পূর্বজর প্রতি প্রণাম জানান নেপাল। শিল্পীদের মহড়া দেওয়ার জন্য গ্রামের মাঝখানে একটি ছোটখাটো হল আর গ্রামে ঢোকার মুখেই আছে গম্ভীর সিংহের মূর্তি।
বরাভূম স্টেশনে নেমে চড়িদা আসার পুরো রাস্তা জুড়ে প্রচুর খেজুর গাছ। শীতের সকালে মন খেজুর রসের বায়না করলে এই মুখোশময় চড়িদাতেও তা মিলবে। শীত থাকলে আলি ভাইএর ঘরেই বসে দেখা যাবে খেজুর গুড় বানানোর বিরল দৃশ্য। চাইলে নলেন গুড় কেনা যাবেরাঢ় বাঙলা আর জঙ্গল মহলের গুড়ের স্বাদই আলাদা চড়িদার পিছনে পাহাড়ের পাদদেশে জঙ্গলের মধ্যে হদহদি ঝরনা। শীতকালে জল না থাকলেও বর্ষায় রূপ দেখার মতো। শালবয়রা,আমলকীর ঘন জঙ্গল পেরিয়ে পাহাড়ের গায়ে এই ঝরনার জায়গাটি বেশ মনোরম। হদহদিতে গিয়ে জল দেখতে না পেলেও চুপ করে বসে থাকলেও নানা পাখির ডাক মন ভরিয়ে দেবে। কখনও দেখা যায় দল বেঁধে গ্রামের মেয়ে-বৌরা কাঠ কাটতেপাতা কুড়োতে জঙ্গলে যাচ্ছেন।অসম্ভব সুরেলা সবার গলা।
সমতল থেকে ৭০০ মিটার উচ্চতায় অযোধ্যা পাহাড়ে জঙ্গলের রাস্তা বেয়ে থুর্গা লেক। বৃষ্টির জলই এই লেকটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বর্ষায় এর রূপ অনন্য। এই লেক থেকে কিছু দূরে বাঘমুন্ডি গ্রাম। অযোধ্যা ও বাঘমুন্ডির জলের একমাত্র উৎস থুর্গা লেক। বিশাল লেকের ঠান্ডা হাওয়া মন জুড়িয়ে দেয়। থুর্গা যাওয়ার পথে রাস্তায় পড়বে মানভূম ট্যুরিস্ট লজ। একদম নির্জন প্রকৃতির মধ্যে যাঁরা থাকতে চানতাঁদের জন্য মানভূম ট্যুরিস্ট লজ আদর্শ। এখানকার কেয়ারটেকারকে বললে খাওয়ার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে।
বিগত কয়েক বছর ধরেই বাঙলার এ ধরণের পারম্পরিক শিল্পী সমৃদ্ধ গ্রামে লৌকিক ভ্রমণের ব্যতিক্রমী পরিকল্পনা করছে কলাবতী মুদ্রা আশা আগামী দিনে বাঙলার ভ্রমণপ্রেমী আর সংস্কৃতি উত্সাহী মানুষ তাঁদের উত্সাহের হাত বাড়িয়ে দেবেন এই উদ্যমে বাঙলার নানান পারম্পরিক উদ্যমের গ্রামগুলিকে নিয়ে তাঁরা এক লৌকিক ভ্রমণের শৃঙ্খলের পরিকল্পনা করছেনসংগঠণ সম্পাদক নেপাল সূত্রধরও চাইছেন তাঁর একফালি জমিতে মাটির বাড়ি বানিয়ে ভ্রমণার্থীদের থাকর ব্যবস্থা করা কলাবতী মুদ্রা সেই পরিকল্পনার ভাগিদার স্থানীয় প্রতিনিধি কে পি সিং দেও উত্সাহ দেখিয়েছেন শিল্প গ্রামে মাটিরবাড়িতে থেকে সেই শিল্প প্রত্যক্ষ্য করা এবং যতদূরসম্ভব তা শিখে নেওয়া যায় আশাকরি অনেকেই এই পরিকল্পনায় শামিল হবেন চড়িদার স্থান হোক বাঙলার হৃদিকমলে

চড়িদা ইকো ইন্ডেক্স
গ্রামঃ চড়িদা, পুরুলিয়া
শিল্পঃ ছো নাচ, ছো মুখোশ
আলাপ করবেন যে জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী শিল্পীর সঙ্গেঃ নেপাল সূত্রধর
রাতে থাকার স্থানঃ ভাবিষ্যতে গ্রমেই থাকার ব্যবস্থার পরিকল্পনা রয়েছে, বর্তমানে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটামোরজন্য দু কিমি দূরে লজে অথবা পুরুলিয়ায় ফিরে আসা
রাস্তাঃ পাকা, গাড়ি যাবে বর্ষায়ও
কাছের রেলস্টেশন আর পরিযানঃ বরাভূম(থেকে ট্রেকারে), পুরুলিয়া(থেকে ভাড়া গাড়ি অথবা বাসে)
গ্রামে সম্ভাব্য মাথাপিছু খরচঃ দৈনিক ৫০০ টাকা(শুধু বাগমুন্ডিতে থাকা আর তিনবেলা খাওয়া)
আবহাওয়াঃ গরমে অসম্ভব গরম আর শীতে বেশ শীত, তবে শীত আর বর্ষাকালের মজাই আলাদা
নিরাপত্তাঃ অসম্ভব ভাল
গ্রামের জনসুবিধাঃ তিন তারা(রাতে গ্রামে থাকার ব্যবস্থা হলে জয়গুরু রাঙ্কিং অর্জন করবে)
(এক তারাঃ চলনসই, দুই তারাঃ ভাল, তিন তারাঃ বেড়ে, চার তারাঃ চমতকার, পাঁচ তারাঃজয়গুরু)

সোমবার, ৩১ অক্টোবর, ২০১১

অতীত বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা৫

ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের উচ্চ পাঠশালাগুলির বিভাগকরণ
১. শিখ দেশি পাঠশালা – গুরমুখী
২. মুসলমান দেশি শিক্ষা ব্যবস্থা – মক্তব, মাদ্রাসা(ধর্মীয়, অধর্মীয়), কোরাণ পাঠশালা
৩. হিন্দু দেশি পাঠশালা – চাটশালা(ব্যবসায়ীগের জন্য), পাটশালা(ধর্মীয়), পাটশালা(আধা ধর্মীয়), বিভিন্নস্তরের অধর্মীয় পাঠশালা
৪. মেলানো মেশানো দেশি পাঠশালা – পারসি পাঠশালা, ভারনাকুলার পাঠশালা, এংলো-ভার্নাকুলার পাঠশালা
৫. মেয়েদের জন্য দেশি পাঠশালা – শিখ মেয়েদের জন্য, মুসলমান মেয়েদের জন্য, হিন্দুমেয়েদের বাড়িতে পড়ার জন্য
তাঁর করা বাংলার এবং দেশের নানান প্রান্তের সমীক্ষা ভিত্তি করে এডাম দেশিয় পাঠশালাগুলোর আরও বিশদ বিভাগ তৈরি করেছেন
ক)মক্তব অথবা মাদ্রাসা – ১. বিভিন্ন স্তরের এবং নির্দিষ্ট বিষয় পড়াবার জন্য আরবি পাঠশালা(স্কুল) আর উচ্চ পাঠশালা(উচ্চতর পাঠশালা) ২। বিভিন্ন স্তরের এবং নির্দিষ্ট বিষয় পড়াবার জন্য পারসিক-আরবি পাঠশালা(স্কুল) আর উচ্চ পাঠশালা(উচ্চতর পাঠশালা) ৩. কোরাণ পাঠশালা- শুধুই কোরাণ পড়াবার জন্য ৪. পারসিক-কেরাণ পাঠশালা, ৫. কোরাণ-আরবি পাঠশালা, ৬. পার্সি-কোরাণ-আরবি পাঠশালা, ৭. পারসিক পাঠশালা, ৮. পারসি-উর্দু পাঠশালা, ৯. পারসি-উর্দু-আরবি পাঠশালা, ১০. আরবি বৈদ্য উচ্চ পাঠশালা, ১১. পার্সি-আরবি বৈদ্য উচ্চ পাঠশালা,
খ) গুরমুখী পাঠশালা – ১২. গুরমুখী পাঠশালা ১৩. গুরমুখী এবং ল্যান্ডে পাঠশালা
গ) মহাজনী পাঠশালা – ১৪. বিভিন্ন ধরনের ল্যান্ডে পাঠশালা(চাটশালা), ১৫. নাগরি ল্যান্ডে পাঠশালা, ১৬. পার্সি ল্যান্ডে পাঠশালা
ঘ) পাঠশালা- ১৭. নাগরি-সংস্কৃত পাঠশালা ১৮. সংস্কৃত ধর্মীয় পাঠশালা, ১৯. সংস্কৃত অ-ধর্মীয় পাঠশালা(বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হয়), ২০. সংস্কৃত আধা-ধর্মীয়(সেমি-সেকুলার) পাঠশালা, ২১. সংস্কৃত বৈদ্য পাঠশাশালা(চিফলি) ২২. হিন্দি সংস্কৃত পাঠশালা, ২৩. সংস্কৃত জোতির্বিদ্যা ও জ্যোতিষবিদ্যা পাঠশালা(চিফলি)
ঙ) মহিলাদের দেশি পাঠশালা(আগে বলা হয়েছে)
যে সব সংস্কৃত পুঁথি পড়ানো হত
বালবোধ, অক্ষর দীপিকা
১.ব্যকরণ- সারস্বত, মনোরমা, চন্দ্রিকা, ভাষ্য, লঘু কৌমুদী, পাণীনি ব্যকরণ, কৌমুদী, সিদ্ধান্ত কৌমুদী, শেখর, প্রাকৃত প্রকাশ
২. শব্দার্থবিদ্যা(লেক্সিকলজি) - অমর কোষ, মালিনী কোষ, হলায়ুধ
৩. কবিতা, নাটক এবং ধর্মীয় ইতিহাস – রঘুবংশ, মহাভারত, মেঘদূত, বেণীসংহার, মাঘ, শকুন্তলা, কীরাত অর্জুণ, নৈষধ চরিত, রামায়ণ, মৃচ্ছকটিক, শ্রীমদ ভাগ্বত, কুমার সম্ভব, অন্যান্য পুরাণ
৪. রেটরিক – কাব্য দীপক, কাব্যপ্রকাশ, সাহিত্য দর্পণ, দশরূপ, কুবলয়ানন্দ
৫. অঙ্ক, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতিষবিদ্যা- সিদ্ধান্ত শিরেমণি নীলকান্তি, শীঘ্রবোধ, বৃহত্ জাতক, পারাশরীয়, গর্ভলগ্ন
৬. বৈদ্যবিদ্যা – শ্যামরাজ, নিঘান্ত, শুশ্রুত, শারঙ্গধর, চরক, ভাষ্য পরিচ্ছেদ, মাধব নিদান, ভাগবত
৭। ন্যায় – ন্যায় শ্রুত বৃত্তি, গদাধরী, ভূতপ্রতিবাদ, তর্কালঙ্কার, তারক সংগ্রহ, কারিকাবলী,
৮. বেদান্ত – আত্মবোধ শরীরক, পাঁচদশী
৯. স্মৃতি – মনুস্মৃতি, পরাশর স্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক গৌতম, মীতাক্ষর
১০. দর্শণ – সাংখ্য তত্ব কৌমুদী, পতঞ্জলী ভাষ্যসহ সূত্র বৃত্তি সূত্র, সাংখ্য প্রবচণ ভাষ্য যোগ সূত্র, বেদান্ত- ভাষ্যান্তর, বৈশেষিক- সিদ্ধান্ত মুক্তাবলী সূত্রসহ ভাষ্যসহ বিবৃতি(আ কমেন্ট্রি), মীমাংসা সূত্রসহ ভাষ্য অর্থসংগ্রহ
১১. প্রসডি – শ্রুত বোধ, ভৃত্য় রত্নাকর
১২. গদ্য সাহিত্য – হিতোপদেশ, দশাবতার, দশকুমার চরিত
১৩. ধর্ম(রেলিজিয়ন) – ঋগ্বেদ সংহিতা, সংবাদ – মন্ত্রভাগ, যয়ুর্বেদ, শুক্ল য়জুর, ছন্দস্য আচারিকা(বেশি পড়ানো হয় না), বাজস্নেয়ী(Vajasneyi) সংহিতা।

অতীত বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা৪

কলকাতা এবং ২৪ পরগণায় হিন্দুদের কতগুলি পাঠশালা ছিল এ তথ্য এডাম জানাতে পারেননি। তবে তিনি ১৮১৮ সালের উইলিয়ম ওয়ার্ডের একটি সমীক্ষা তুলেধরে বলছেন কলকাতার আশেপাশে ২৮টি পাঠশালা ছিল। ওয়ার্ড প্রত্যেকটি পাঠশালার শিক্ষকের নাম, কোন অঞ্চলে সেগুলির অবস্থান এবং কত বটু এই পাঠশালাগুলিতে পাঠ নিত তার উল্লেখ করেছেন। এই সব বিদ্যালয়ে ন্যায় আর স্মৃতিশাস্ত্রের পাঠদান হত। মোট বটুর সংখ্যা ছিল ১৭৩জন। উচ্চ পাঠশালাগুলিতে তিন থেকো ১৫জন বটু একজন শিক্ষকের কাছে পাঠ গ্রহণ করত। এদের নামগুলি
শিক্ষককের নাম এলাকা বটুর সংখ্যা
অনন্তরাম বিদ্যবাগীশ হাতিবাগান ১৫
রামকুমার তর্কালঙ্কার ঐ ৮
রামতোষন বিদ্যালঙ্কার ঐ ৮
রামদুলাল চুড়ামণি ঐ ৫
গৌরমণি ন্যায়লঙ্কার ঐ ঐ
কাশীনাথ তর্কবাগীশ ঘোষালবাগান ৬
রামসেবক বিদ্যাবাগীশ শিকদারেরবাগান ৪
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বাগবাজার ১৫
রামকিশোর তর্কচূড়ামণি ঐ ঐ
রামকুমার শিরোমণি ঐ ৪
জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন তালেরবাগান ৫
শম্ভু বাচষ্পতি ঐ ঐ
শিবরাম ন্যায়বাগীশ লালবাগান ১০
গৌরমোহন বিদ্যাভূষণ ঐ ঐ
হরিপ্রসাদ তর্কপঞ্চানন হাতিবাগান ৪
রামনারায়ণ তর্কপঞ্চানন সিমলা ৫
রামহরি বিদ্যাভূষণ হরতুকিবাগান ৬
কমলাকান্ত বিদ্যালঙ্কার আড়কুলি ৬
গোবিন্দ তর্কপঞ্চানন ঐ ৫
পীতাম্বর ন্যায়ভূষণ ঐ ৫
পার্বতী তর্কভূষণ ঠনঠনিয়া ৪
কাশানাথ তর্কালঙ্কার ঐ ৩
রামনাথ বাচষ্পতি সিলমা ৯
রামতনু তর্কসিদ্ধান্ত মলঙ্গা ৬
রামতনু বিদ্যাবাগীশ শোভাবাজার ৫
রামকুমার তর্কপঞ্চানন বীরপাড়া ৫
কালিদাস বিদ্যাবাগীশ ইটালি ৫
রামধুন তর্কবাগীশ সিমলা ৬
এডাম, ১৮০১সালের হ্যামিলটনের সমীক্ষা ভিত্তি করে বলছেন, কলকাতার আশেপাশে এবং সমগ্র ২৪ পরগণা জুড়ে ১৯০টি সনাতন উচ্চশিক্ষার পাঠশালা ছিল, যেখানে স্মৃতি, ব্যকরণ আর সাংখ্য পড়ানো হত।
ওয়ার্ডএর সমীক্ষা থেকে ধার করে এডাম নদিয়া জেলায় ৩১টি উচ্চশিক্ষার বিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করছেন। সব মিলিয়ে ৭৪৭জন বটু পাঠ নিত। ওয়ার্ডের সমীক্ষা অনুসারে নদিয়ার যে সব উচ্চশিক্ষাকেন্দ্রের কথা বলছেন তা তুলে দেওয়া গেল
ন্যায় পাঠশালা
গুরুর নাম ছাত্রের সংখ্যা
শিবনাথ বিদ্যাবাচষ্পতি ১২৫
রামলোচন ন্যায়ভূষণ ২০
কাশীনাথ তর্কচূড়ামণি ৩০
অভয়ানন্দ তর্কলঙ্কার ২০
রামশরণ ন্যায়বাগীশ ১৫
ভোলানাথ শিরোমণি ১২
রাধানাথ তর্কপঞ্চানন ১০
রামমোহন বিদ্যাবাচষ্পতি ২০
শ্রীরাম তর্কভূষণ ২০
কালীকান্ত চূড়ামণি ৫
কৃষ্ণকান্ত বিদ্যাবাগীশ ১৫
তর্কালঙ্কার ১৫
কালিপ্রসন্ন ১৫
মাধব তর্কসিদ্ধান্ত ২৫
কোমলকান্ত তর্কচূড়ামণি ২৫
ঈশ্বর তর্কভূষণ ২০
কান্ত বিদ্যালঙ্কার ৪০

স্মৃতির উচ্চতর পাঠশালা
রামনাথ তর্কসিদ্ধান্ত ৪০
গঙ্গাধর শিরোমণি ২৫
দেবী তর্কালঙ্কার ২৫
মোহন বিদ্যাবাচষ্পতি ২০
গাঙ্গুলি তর্কলঙ্কার ১০
কৃষ্ণ তর্কভূষণ ১০
প্রাণকৃষ্ণ তর্কবাগীশ ৫
পুরোহিত ৫
কাশীকান্ত তর্কচূড়ামণি ৩০
কালীকান্ত তর্কপঞ্চানন ২০
গদাধর তর্কবাগীশ ২০
কাব্য পড়ানোর উচ্চতর পাঠশালা
কালীকান্ত তর্কচূড়মণি ৫০
জ্যোতির্বিদ্যা পড়ানোর উচ্চতর পাঠশালা
গুরুপ্রসাদ সিদ্ধান্তবাগীশ ৫০
ব্যকারণ পড়ানোর উচ্চতর পাঠশালা
শম্ভুনাথ চূড়ামণি ৫

অতীত বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা৩

তিনি গুরুমশাইদের পাওয়া মাইনের সঙ্গে গ্রামের প্রায় একই স্তরের কাজ করা মানুষের রোজগারের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। স্থানীয় জমিদারদের নানান কাজে যারা নিযুক্ত হতেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন পাটওয়ারি, আমিন, শুমারনাভি আর খামারনভিস। পাটওয়ারির কাজ ছিল বাড়ি বাড়ি গিয়ে জমিদারদের খাজনা উশুল করা, মাইনে পেতেন দুটাকা আট আনা সঙ্গে রায়তদের কাছথেকে শষ্য উঠলে বেশ কিছু জিনিষপত্তরও যার প্রায় মূল্য আট আনা, সবে মিলিয়ে তিন টাকা। আমিনদের কাজ ছিল জমিদারদের পক্ষে গ্রমের জমিজমার পরিমান মেপে বিবাদের সমাপ্তি ঘটাতেন। তিনি পেতেন মাসে সাড়ে তিন টাকা থেকে চার টাকা। শুমারনভিস পাটওয়ারিদের আদায়ের হিসেব রাখতেন, পেতেন পাঁচ টাকা প্রতি মাসে। আর অনেক জমিদার জমির ফসল থেকেই যখন খাজনা আদায় করার জন্য খামারনভিস রাখতেন তারা অনেক কম অর্থ পেতেন। জমিদারিতে যেসব আমলা কাজকরতেন তাদের অনেকেরই উপরি আয়ের সুযোগ থাকত, যে সুযোগটি এই গুরুমশাইদের ছিলনা।
গ্রামে পাঠশালার জন্য আলাদা করে গৃহ স্থাপিত হত না। যে স্থানে বটুরা পাঠ নিত সেই স্থানটি নানান কাজে নানাম সময়ে ব্যবহৃত হত। কেউ কেউ চন্ডিমন্ডপেই পাঠদিতেন, পাঠগ্রহণ ছাড়াও সেখানে সারা বছর নানান ধরনের পুজো, পার্বন ও অনুষ্ঠান হত। কোথাও কোথাও গ্রামের আড্ডার জন্য নির্দিষ্ট বৈঠকখানায়ও এই পাঠশালা আয়োজিত হত। কোনো কোনো পৃষ্ঠপোষক আবার নিজের বাস্থানের এক অংশ ছেড়ে দিতেন পাঠশালের জন্য। ৩০-৪০বটর জন্য যে সব পাঠশাল, সেগুলো বছরের শুকনো সময়ে খোলা যায়গায় আর বর্যার সময় তিন চারটি অস্থায়ী পাতায় ছাওয়া কুঁড়ে ঘরে হয়। বেশি বর্যা এলে বটুদের পাততাড়ি্ গুটেতে হত। ছাপার হরফে পুস্তকের কথা গ্রামাঞ্চলে কেউ জানতইনা বলা চলে। তবে কিছু কিছু ছাপাই পঞ্জিকা(এলম্যনাক) অবস্থাপন্ন পরিবারের গৃহস্থরা কলকাতা থেকে কিনে নিয়ে যেতেন। একজনও গুরুমশাই ছাপার বই দেখেননি। এডাম এদের স্কুল বুক সোসাইটির প্রকাশনায় পুস্তক দেখান। গুরুমশাইরা এগুলো খুবেশি গুরুত্ব দেননি। সোসাইটি বইগুলি বিক্রির জন্য বাউলিয়ায় একজন দালাল ঠিক করেছে বলেও তিনি জানান। প্রত্যেক গুরুমশাই তাঁর স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করে পাঠদান করতেন। পাঠশাল শেষ হত স্বরস্বতী বন্দনা দিয়ে। একজন নেতা পোড়ো এই বন্দনা আবৃত্তি করত, বটুদের প্রত্যেককে ভুঁইএ মাথা ঠেকিয়ে বন্দনার একটার পর একটা স্তবক আবৃত্তি করতে হত যাতে এই বন্দনাটি তাদের স্মরণে থাকে। এছাড়াও ছড়ায় ছড়ায় শুভঙ্করী(এডামের ভাষায় ককার অব বেঙ্গল)ও শেখানো হত।
বাঙলা মাধ্যমে শিক্ষাদানের চারটি স্তর ছিল। প্রথম পর্বে মাটিতে বাঁশের বাঁখারি বা লাঠি দিয়ে আঁক কেটে অক্ষর শেখানো হত। জেলায় সাধারণতঃ অর্থ সাশ্রয়ের জন্য বালির বেদি ব্যবহার করা হত। এই পর্ব দশ দিনের বেশি চলত না। দ্বিতীয় পর্বে তালপাতার ওপর লেখা আর অক্ষরের উচ্চারণ শেখানো হত। এসময় অক্ষরগুলোর মাপ শেখানো হত না। এই পর্ব চলত দুবছর থেকে চার বছর পর্যন্ত। এ সময় যুক্তাক্ষর, স্বরভক্তি(syllables formed by the junction of vowels with consonants), সাধাহর স্থান নাম, ব্যক্তির নামও শেখানো হত। অন্য গ্রামগুলিতে জাতি, নদী, পর্বত এত্যাদের নামও শেখানো হত। কড়ি আর শতকিয়াও শেখানো হত। কাথা(জমির মাপ) তালিকা, সের তালিকা(ওজনের মাপ)ও শেখানো হত। তৃতীয় স্তরও দুই থেকে তিন সপ্তাহ। এ সময় প্ল্যানটোন পাতা(কলাগাছের পাতা!) দিয়ে শব্দ দিয়ে সরল বাক্য শেখানো হত। শব্দের কথ্য আর লেখন পার্থক্যও মুখে শেখানো হত(abbreviated in speech by the omission of a vowel or a consonant, or by the running of two syllables into one)। এই শেখাকে লিখতেও শেখানো হত। correct orthography of words of Sanscrit origin which abound in the language of the people। এই সময়ে বটুদের শেখানো হত সরল অঙ্ক, যোগ-বিয়োগ। কিন্ত গুণ আর ভাগ আলাদা আলাদা করে শেখানো হত না। গুনের নামতা ২০ অবদি মুখস্ত করতে হত। রোজ পাঠশালা শুরু হওয়ার পরই এই নামতা পড়ানো হত।
সাধারণ অঙ্ক শেখার পর কৃষি আর সাধারণ বাণিজ্যের অঙ্কও শেখানো হত। কৃষিতে বা বাণিজ্যে জমা-খরচের খাতা কীভাবে রাখতে হয়, তাও শেখানো হত। দৈনিক মজুরির হার থেকে মাসিক অথবা বার্ষিক মজুরির হার বার করতে হত। কাঠা আর বিঘার মধ্যেকার সম্পর্কও অঙ্ক কষে বার করতে হত। দৈর্ঘ, প্রস্থ দেওয়া থাকলে একটি জমির সাধারণ ক্ষেত্রফল কী হবে তাও জানতে হত। একটি নির্দিষ্ট পরিমান জমি থেকে কত খাজনা দেয় হয় তাও জানতে হত বটুদের। খাতা রাখার সাধারণ হিসেবও শিখতে হত বটুদের। সের মনএর মধ্যেকার আর তোলা আর ছটাক সম্পর্কও কষতে হত। প্রত্যক টাকায় আনা আর কড়ির সংখ্যাও শেখানো হত। এক টাকার সুদও কষতে হত। একটাকার কমের মুদ্রামানের বিনিময় মূল্য – বাটাও শেখানোর ব্যবস্থা ছিল। চতুর্থ বা শেষস্তরে দুই বা তিন বছরের মধ্যে শেষ হত। এই পর্বে থাকত ব্যবসার পদ্ধতি, ব্যবসার চিঠি, গ্রান্ট, লিজ, একসেপটেন্স, হাত চিটা ইত্যাদি শেখানো হত। এক বছরের মধ্যে যে বটু নিজে নিজেই এ সমস্ত লিখতে পারত তাকেই কৃতকার্য রূপে ধরে নেওয়া হত। এছাড়াও রামায়ন মনসা মঙ্গলের নানান ছত্রও আবৃত্তি করতে হত।
সমীক্ষা অনুসারে বাংলায় তিন ধরণের উচ্চশিক্ষার উচ্চ পাঠশালা ছিল। কোথাও ব্যকরণ, অলঙ্কার, আর কোথাও কোথাও পৌরাণিক কাব্যও পড়ানো হত। দ্বিতীয়গুলিতে স্মৃতি আর কিছুটা পৌরাণিক কাব্য পড়ানো হত। তৃতীয় উচ্চ পাঠশালাগুলি লজিককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত। এই তিনধরণের বিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট কিছু পাঠ্য পড়ানো হত। গুরুমশাই কিন্তু এই সব পাঠদান কেন্দ্রে দীর্ঘ বক্তৃতা দিতেন না। পাঠশালাগুলিতে ছাত্ররা নানান প্রশ্ন করত আর গুরুমশাই তার উত্তর দিতেন। প্রত্যেক শ্রেণীকক্ষে নির্দষ্ট মানের ছাত্রদের তাদের পাঠগ্রহণের ক্ষমতা অনুযায়ী আলাদা আলাদা করে বসানো হত। সামনে পুঁথি খুলে সবথেকে ভাল পড়তে পারা ছাত্রটি সশব্দে পাঠগুলি উচ্চারণ করত, শিক্ষক তার উত্তর দিতেন। এই ভাবে পড়াশোনা এগোত। সাধারণ ব্যকরণ শিখতে দুই থেকে ছয় বছর পর্যন্ত সময় লাগত, কিন্তু পাণিনী শিখতে নিদেন পক্ষে লাগত দশ বছর কখোনো আবার বারো বছরও। ব্যকরণ শেখার পর কাব্য, মীমাংসা আর দর্শণও পাঠ নিতে পারত। যে সব ছাত্র ন্যায় অথবা মিমাংসা পড়ত তাদের সময় লাগত ছবছর পর্যন্ত। এমনকী তাকে অন্য বিদ্যালয়েও যেতে হত। ওয়ার্ড বলছেন একলাখ ব্রাহ্মণের মধ্যে এক হাজারমাত্র সংস্কৃত ব্যকরণ শিখতেন, এদের মধ্যে চারশ থেকে পাঁচশ কাব্য পড়তেন, পঞ্চাশ জন হয়ত অলঙ্কার শাস্ত্রে পন্ডিত ছিলেন। এই হাজারের মধ্যে শচারেক স্মৃতির পাঠোদ্ধার করতে পারতেন। এদের মধ্যে মাত্র জনা দশেক তন্ত্র সম্বন্ধে বিশারদ ছিলেন। ন্যায় বিশারদ ছিলেন শতিনেক, পাঁচ থেকে ছজন শুধু মিমাংসা, বেদান্ত, পতঞ্জলি, বৈশেষিক অথবা বেদ পড়াতে পারতেন। দশজন জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। পঞ্চাশ জনের কাছাকাছি শ্রীভাগবত বা পুরাণ মুখস্ত করতেন।

অতীত বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা২

এডাম পাঁচটি জেলায় যে বিষয়গুলি নিয়ে বিশদে তথ্য গ্রহণ করেন, ১) বুনিয়াদি পাঠাশালা আর বটুদের জাত বিভাগ, ২) ঐ আর গুরুমশাইদের জাত বিভাগ, ৩) কী ধরনের পাঠদানব্যবস্থা ছিল, ৪) সংস্কৃত শিক্ষার অবস্থা কী ছিল, ৫) সংস্কৃত শিক্ষায় কী ধরনের বই ব্যবহৃত হত, ৬) পারসিক আর আরবি উচ্চ পাঠশালাগুলির বিশদ ৭) এই উচ্চ পাঠশালাগুলোতে কী ধরনের বই ব্যবহার হত ইত্যাদি। পাঠশালাগুলি নিয়ে এডাম কী বলছেন একটু শুনি। তাঁর মতে বাংলা আর বিহার মিলিয়ে, ১,৫০,৭৭৪টি গ্রামে বাংলা-বিহারে এক লাখেরও বেশি পাঠশালা রয়েছে। সবকটি গ্রামে নাথাকলেও অধিকাংশতেই পাঠশালা বিদ্যমান। কোনো কোনো গ্রামে ছটাও পাঠশালার খবর পাওয়া যাচ্ছে। পাঠশালাগুলির উপযোগিতা নিয়ে এডামের বক্তব্য, It is not, however, in the present state of these schools, that they can be regarded as valuable instruments for this purpose। The benefits resulting from them are but small, owing partly to the incompetency of the instructors, and partly to the early age at which through the poverty of the parents the children are removed।
পাঠদান শুরু হত পাঁচ বা ছবছরেই। এই বুনিয়াদি শিক্ষাদান চলত পাঁচ বছর ধরে। বটুদের দেয় অর্থের ওপরেই গুরুমশাইদের দিনগুজরান হত। নিজেদের রোজগার বাড়াবার জন্য গুরুমশাইরা প্রতিবেশি অঞ্চল থেকে সম্মানীয় বা অর্থবান পরিবারের বটু ভর্তি করত। পাঠদানপদ্ধতি নিয়েও এডাম বিশদে বলেছেন। স্বরবর্ণ শিক্ষা সমাপ্ত হলে ব্যাঞ্জনবর্ণ শিক্ষাদান হত। মাটিতে বালি লেপে তার ওপরে আঙুল অথবা লাঠি্দিয়ে এই বর্ণগুলি মকশ করা হত। এরপর মাটিতে সাদা লাঠি দিয়ে ফুটিয়ে তোলাহত বর্ণগুলোর চেহারা। এই কাজটি চলত আট থেকে দশদিন পর্যন্ত। এরপর লালা রঙএ খাগের কলম তালুতে(এডাম স্পষ্ট বলছেন আঙুলে নিয়ে নয়) ধরে সেটি তালপাতার ওপর কালোরঙএর ভুসো কালিতে চুবিয়ে, স্বরবর্ণের সঙ্গে ব্যাঞ্জন বর্ণের মিলন, যুক্তবর্ণ, স্বরভক্তি(সিলেবল), শব্দ শিখতে হত। এ ছাড়াও তারা শিখত নিউমারেশন, টাকা, ওজন(ওয়োটস ওন্ড মোজার্স) আর বিভিন্ন ব্যক্তি, জাতি, ও স্থানের নাম সঠিকবর্ণে সঠিকভাবে লিখতে পারা শেখানো হত। এই কাজগুলি চলত এক বছর ধরে। এরপর এডভানসড স্টাডি। বাতির কালোশিষ ধরে কলাপাতায় শেখানো হত সাধারণ যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ। এরপর খুব সরল জমি, বাণিজ্য ও কৃষিকাজের জন্য পাটিগণিত শেখানো হত। গ্রামের পাঠশালাগুলিতে কৃষিবিযয়ক অঙ্ক বিশেষ করে করানো হত। আর শহরে নানান বাণিজ্যে দিকগুলি নিয়ে অঙ্ক শেখানো হত। তিনি বলছেন বটুদের নীতি শিক্ষা দেওয়ার জন্য কোনো বিদ্যালয়েই পাঠ্যপুস্তকের প্রচলন ছিলনা। তাঁর মতে এতে বটুদের নীতিশিক্ষা হত না।
তিনি বলছেন হিন্দু আইন অনুযায়ী বটুদের পাঠগ্রহনের প্রবেশের বয়স ছিল পাঁচ বছর। পাঁচবছরে না হলে, সাত বা নয়, বিজোড় বছরেও পাঠ শুরু হত। বছরের এক নির্দিষ্ট মাস, মাসের এর নির্দিষ্ট সপ্তাহ আর সপ্তাহের এক নির্দিষ্ট দিনেই একটি ছাত্রের পাঠদানপ্রক্রিয়া শুরু হত। এই দিনেই পরিবারের পুরোহিত, দেবী সরস্বতীর পুজো দিয়েই ছাত্রের হাত ধরে বর্ণের ওপর মকশ করিয়ে সেগুলি উচ্চারণ করতে বলতেন। তবে প্রত্যেক হিন্দুই যে এ ধরণের পুজো-অর্চনা পালন করত তা বলা যায় না, যাদের বিশেষরূপে পাঠদানের সামর্থ রয়েছে, একমাত্র তারাই এ ধরনের পুজার্চনা করতেন এবং পরেরদিন থেকেই সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতেন। তবে রাজসাহিতে এ ধরনের কোনো নির্দিষ্ট বয়স দেখিনি। ছাত্রের পাঠ গ্রহণ ক্ষমতা অথবা পরিবারের আর্থিক সামর্থের ওপরেই নির্ভর করত পাঠশালায় প্রবেশের বয়স। তবে কোন বয়সে শুরু করছে, তার ওপরেই নির্ভর করত কবে সে উচ্চ পাঠশালা থেকে কবে ছাড়া পাবে। তিনি নাটোরএর ১৭৬টি পাঠশালার উল্লেখ করছেন, যেখানে পাঠশালায় প্রবেশর বয়স পাঁচ থেকে শুরু করে দশ বছর পর্যন্ত ছিল। কোনো শিক্ষক থেকে শিক্ষকে পাঠদানের সময়সীমা বদলাত – পাঁচ থেকে দশ বছর।
শিক্ষকেরা তরুণ থেকে প্রবীণ পর্যন্ত হতেন। তারা সরল, সধারণ, অজ্ঞ(ইগনোরেন্ট) এবং গরীব তাই অন্য কোনো পেশায় প্রবেশের সুযেগ থাকে না। কিন্তু যে অঞ্চলে তাঁরা পাঠদান করেন সেই অঞ্চলে তাঁদের সম্মান ছিল অপরিমিত। তারা অনেকেই জানতেন না কী গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাঁরা করছেন। যে কাজ করছেন, তার পেছেনে তাদের খুব একটা ভাবনা চিন্তাও ছিল না। বটুদের ওপরেও তাদের প্রভাবও বেশি হত না। এছাড়াও শিক্ষকদের সম্বন্ধে তিনি খুব একটা উচ্চধারণা পোষণ করতেন না তা তাঁর প্রতিবেদন থেকেই স্পষ্ট। শিক্ষকদের সাম্মানিক আসত শুধুমাত্র বিভিন্ন সূত্রে। দুজন শিক্ষক তাঁদের সমগ্র আর অন্যরা সাম্মানিকটুকুর একাংশ পেতেন গ্রামের কোনো সহৃদয় দানশীল ব্যক্তির দান থেকে। এক চতুর্থাংশের সাম্মানিক আসত বটুদের দেয় অর্থের থেকে। অন্যান্যদের সাম্মানিক আসত কিছুটা অর্থ আর কিছুটা পণ্যদ্রব্যের বিনিময়ে। সাধারণ ভাবে তিনটিস্তরে পড়াবার মাধ্যমের বিস্তৃতি ছিল, প্রথমটি মাটি, তালপাতা, শেষ মাধ্যম ছিল কাগজ। প্রত্যেক স্তরে পাঠাদানের শুরু থেকে আরও একটু বেশি মাইনে ধার্য হত। কোথাও কোথাও প্রথম আর দ্বিতীয়স্তর একটিস্তর হিসেবেই দেখা হত। কোথাও কোথাও দ্বিতীয় আর তৃতীয়স্তরে একই মাইনে দাবি করা হত। কোথাও আবার প্রত্যক স্তরের জন্য একই অর্থের মাইনে ছিল। তবে সাধারণঃ প্রত্যেকস্তরের জন্য আলাদা আলাদা পরিমান অর্থই দাবি করা হত। আবার বটুদের পরিবারের স্বচ্ছলতার ওপর নির্ভর করত মাইনে। অর্থবানদের তুলনায় গরীব বটুদের কখোনো অর্ধেক, কোথাও একচতুর্থাংশ, কোথাও আবার একতৃতীয়াংশ অর্থ মাইনে হিসেবে নেওয়া হত।
গুরুদের মাইনে মাসে চার আনা থেকে শুরু করে পাঁচ টাকা পর্যন্ত হত। যারা কম অর্থ পেতেন তাদের কাপড় দেওয়া হত, আর চাষীদের কাছ থেকে চাষের জিনিষও পেতেন। এছাড়াও কেউ হয়ত শুধুই প্রতিদিনকার খাদ্য পেতেন, কেউবা এর সঙ্গে পরিধেয় ধোয়া, অথবা তাঁর সমস্ত খরচপাতিও পেতেন। যিনি খাদ্যপেতেন তাঁর হয় নিজের বাসস্থান থাকত অথবা গ্রামের অবস্থাপন্ন ব্যক্তির ভদ্রাসনে থাকতেন। সামগ্রিকভাবে শুধু আর্থিক অথবা কিছুটা আর্থিক আর কিছুটা অন্যান্যভাবে যাঁরা রোজগার করতেন, তাঁদের প্রত্যেক মাসের রোজগার ছিল তিনটাকা আটআনা থেকে সাত টাকা আট আনা পর্যন্ত, গড়ে পাঁচটাকার বেশি সকলেই রোজগার করতেন। তিনি উদাহরণস্বরূপ ধারাইলের বিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এই গ্রামে চৌধুরিদের চারটি পরিবার বাস করত। এরাই গ্রামের সম্ভ্রান্ত। কিন্তু এদের আর্থিক অবস্থা এত ভাল ছিলনা, যে অন্যান্যদের সাহায্য ব্যাতীত তাঁরা গুরুমশাই নিয়োগ করতে পারেন। এংরা বাড়ির এক অংশে গুরুমশাইএর থাকার ব্যবস্থা করেন, যেখানে বটুরা পড়াশোনাও করত। এই স্থানটি পুজোর জন্যও ব্যবহার হত আবার অতিথি নিবাসও ছিল। দুটি পরিবার চারআনাকরে, তৃতীয় পরিবার আটআনা আর চতুর্থজন বারো আনা এই কাজে দিতেন। এর বাইরে তাঁরা আর কোনো কিছুই দিতেন না। এই অর্থে পাঁচটি বটু বাঙলা ভাষায় শিক্ষা পেত। কিন্ত এই অর্থে গুরুমশাইএর চলা মুশকিল ছিল, তাই তিনি অন্য পরিবার থেকে বটুর ব্যবস্থা করতেন – এক বটু দিত একআনা, একজন তিন আনা, পাঁচজন চার আনা করে গুরুমশাইকে মাসে সাম্মানিক দিত। এর বাইরে নানান শষ্য, মাঠ, চাল আর কখোনো কখোনো কেউ রুমাল(গামছা!), ফতুয়ারমত(আপার গার্মেন্ট) নানান পরিধেয়ও দিত। কাগবাড়িয়ার দুটি পরিবারের পাঁচটি বটু ধারাইল পাঠশালায় পাঠ নিত। এই দুই গ্রামের মধ্যে প্রায় এক মাইলের পার্থক্য।

অতীত বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা১

অষ্টাদশ শতাব্দ পর্যন্ত নানান সামাজিক-অর্থনৈতিক ঝড়-ঝাপটা সহ্যকরে বাংলার সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড়িয়েছিল মাথা উঁচু করে। উইলিয়ম এডাম ১৮৩৫-৩৮ পর্যন্ত সমীক্ষা করে বাংলা-বিহারে অন্ততঃ এক লাখ পাঠশালা দেখেছেন। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই রেভারেন্ড এফ ই কে লিখছেন, “there was---, before the British Government took over the control of education in India, a widespread, popular, indigenous system। It was not confined to one or two provinces, but was found in various parts of India, though some districts were more advanced than others। In the inquiry made for the Madras Presidency in 1822-26, it was calculated that rather less than one-sixth of the boys of school-going age received education।।। In the similar inquiry made for the Bombay Presidency (1823-28), the number of boys under instruction was put down to about one in eight।।।” ১৮১৪ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টরদের পাঠানো প্রথম এডুকেশন ডেসপ্যাচ এপর নির্ভর করে এ পি হাওয়েল ১৮৫৪তে বলবেন, “There is no doubt that from time immemorial indigenous schools have existed।।। In Bengal alone, in 1835, Mr। Adam estimated their number to be 100,000; in Madras, upon an inquiry instituted by Sir Thomas Munro in 1822, the number of schools was reported to be 12,498, containing 188,650 scholars; and in Bombay, about the same period, schools of a similar order were found to be scattered all over the Presidency।
এর থেকে পরিষ্কার ভারতের প্রায় প্রত্যেক প্রান্তে দেশিয় পাঠশালার অস্তিত্ব বর্তমান ছিল। প্রত্যেক অঞ্চলের বিদ্যালয়ের শিক্ষা কাঠামো, পাঠদান বা অন্যান্য পরিকাঠামো আলাদা আলাদা, সেই অঞ্চলের প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে, ষ্পষ্টতঃই তখোনো বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্রিটিশ প্রণীত এককেন্দ্রিকতা গড়ে ওঠেনি। শেখার বিষয় হিসেবে মগধে পড়ানো হত তুলসিদাস রামায়ণের নানান ঘটনাবলী নির্ভর দান লীলা, সুদামা চরিত, রাম জনম। বাংলায়ও একই জিনিষ পড়ানো হত, তবে ভাষা আলাদা, বাংলা। ত্রিহুতের শিক্ষার মাধ্যম ছিল মৈথিলি বা ত্রিহুতিয়া। এই উচ্চ পাঠশালাগুলোতে সংস্কৃত বা পারসিক মাধ্যমে পড়ানো হত না। বাংলা প্রদেশের অভিজ্ঞতা থেকে পরিস্কার, বাংলার গ্রামে গ্রামে দেশজ ভাষায় পড়ানোর একটি সুসংগঠিত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ শাসন আমলের অনেক আগে থেকেই। কারা পড়তেন! এডাম বলছেন, “Commercial accounts।।। are chiefly acquired by the class of money-lenders and retail traders, agricultural accounts।।। by the children of those families whose subsistence is exclusively drawn from the land, and both accounts by those।।। who expect to gain their livelihood as writers, accountants, etc। গ্রামের পাঠশালাগুলো ছিল গ্রামের নানান শ্রেণীর মানুষের চাষী, কর্মকার, শিল্পী আর ব্যবসায়ীদের সন্তানদের শিক্ষা কেন্দ্র। আর এস শর্মা বলছেন ছ শতাব্দ থেকে গ্রামের সমষ্টির মধ্যে শ্রেণীগত ঐক্য গড়ে উঠেছিল, আর গ্রামের নানান উত্পাদনের প্রক্তিয়ার মধ্যে দিয়ে গ্রামীণদের মধ্যে আত্মীয়তার আর পণ্যদ্রব্যগুলির প্রতি অধিকারবেধের গর্ববাখান তৈরি হচ্ছিল। কৃষির সঙ্গে কর্মশালার সরাসরি মেলবন্ধনে গড়ে উঠছিল নিজে কাজ করার গর্ব, কাজের প্রতি অধিকারবোধ, নিজের কৌমের প্রতি ভালবাসা এবং স্বনির্ভর গ্রাম গোষ্ঠী। গ্রামে জাতিবিভেদ ছিল কিন্তু গ্রামের সামগ্রিকতাবোধ এতই জোরালো ছিল যে, এই ভেদাভেদ উত্পাদনের কাজকর্মে খুব একটা বড় হয়ে দেখা দিত না। আর আমরা জানি কৃষি আর শিল্পে, উভয়ের বিকাশে গ্রাম পঞ্চয়েতের বড় একটা ভূমিকা ছিল। পঞ্চায়েত নিজের রোজগারে সেচ ব্যবস্থা, সাধারণ পতিত জমি উদ্ধারেরমত নানান কাজে অংশ নিত সরাসরি।
এডামের শিক্ষা সমীক্ষায় বলাহচ্ছে মেদিনীপুর, বর্ধমান, বীরভূম বা ত্রিহুতেরমত জেলাতে বিস্তৃতভাবে সমীক্ষা করে লিখছেন, একলাখ পাঠশালায় গুরুমশাইদের কখোনো অর্থে আবার বা কখোনো পণ্যে বিদায় দেওয়া হত। পাঠশালার স্থান নির্বাচন করতেন গ্রামের মানুষেরাই। তিনি স্পষ্টভাবে লিখছেন, "indigeneous elementary schools।।। are those ।।। in which instruction in the element of knowledge is communicated, and which have been originated and are supported by the natives themselves, in contradistinction from those that are supported by religious or philanthropic societies"। এই উচ্চ পাঠশালাগুলি চালানোর দায় ছিল গ্রাম সমষ্টির। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আরও একটা বড় প্রচার ছিল যে, বাংলার হিন্দু-মুসলসমানের মুখ দেখাদেখি ছিলনা। এই ধারণা সর্বৈব মিথ্যে। এই পাঠশালাগুলোর বটুদের মধ্যে দুই ধর্মেরই শিশু পাঠ নিত এক সঙ্গে বসে। গুরুজীর সামনে সমাজের নানান বর্ণের বটুরা একসাথেই পাঠ নিত আট বছর পর্যন্ত। দক্ষিণ বিহারের এক পাঠশালার হিসেব দিচ্ছেন এডাম। শিক্ষকদের মধ্যে মুসলমান ছাড়াও ছিলেন কায়স্থ, মগধ, গন্ধবণিক, তিলি, কোইরি, সোনার শ্রেণীর। হিন্দুদের বটুদের মধ্যে ছিল দেসাধ, পাসি, সুশাহর, ধোবি, তাঁতি, কালাবর, বেলদার, গোয়ালা, নাপিত, কাহার, কুর্মি, কোইরি, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ইত্যাদি। বীরভূমে তিনি হিন্দু, মুসলমানএর সঙ্গে খ্রিষ্টিয় শিক্ষকের নাম পাচ্ছেন(এ সব সত্বেও সাম্রাজ্যবাদীদের অনুসরণ করে মেকলের পুত্রকন্যাদের বলতেই হবে, বাংলা তথা ভারতের সমাজ ছিল জাতপাত ভিত্তিক, একজাতের লোক অন্যজাতের ছোঁয়া পর্যন্ত মাড়াত না)। ৪০০ জন শিক্ষক ছিলেন হিন্দু এদের মধ্যে ছিল ২৪টি জাতি – চন্ডাল(হায়! আমি চন্ডালের কন্যাও লিখেফেল্লেন নোবেলিয় কবি, না হলে নোবেল লাভ!), ধোবি, তাঁতি, কৈবর্ত, গোয়ালাও। বটুদের মধ্যে ছিল মুসলমান, খ্রিস্টান, সাঁওতাল, ধাঙড়, ডোম, চন্ডাল, তেলি, ব্যধ, যুগি, তাঁতি, হাড়ি, কুর্মি, মালি, ব্রাহ্মণ, কায়স্থ প্রভৃতি। এডাম স্পষ্ট লিখছেন, "Parents of good caste do not hesitate to send their children to schools conducted by teachers of an inferior caste and even of different religion। For instance, the Musalman teacher।।। has Hinuds of good caste among his scholars and this is equally true of the Chandal and other low caste teachers enumerated। ।।। "the Musalman tecahers have Hindu as well as Musalman scholars and the different castes of the former assemble in the same school-house, receive the same insturctions from the same teacher, and join in the same plays and pastimes। অথচ উন্নতিশীল বাংলার মধ্যবিত্ত আর বুদ্ধিজীবিদের প্রচেষ্টায় উঠেগেল বাংলার সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা। মেকলের আগেও জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশনের সদস্য হোল্ট ম্যাকেঞ্জি ১৮৩২এ বলছেন To provide for the education of the great body of the people seems to be impossible। আদতে পার্মানেন্ট সেটলমেন্টএর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হাত ধরে তৈরি হল এক শ্রেণীর জমিদার গোষ্ঠী, যাদের জমির মালিক হিসেবে অধিকার দেওয়া হল, যাদের গ্রামগুলোর উন্নয়ণে কোনও উত্সাহ ছিল না। গ্রামে যতরকম এজমালি, নিষ্কর জমি ছিল সব প্রায় দখল নিয়ে খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা হল। গ্রাম সমাজের সলিল সমাধির সঙ্গে ভেঙেগেল সমাজের নিজস্ব শাসন ব্যবস্থার যত পরিকাঠামো, যা গড়ে উঠেছিল হাজার হাজার বছর ধরে তিল তিল করে গ্রামীণদের অনবরত প্রচেষ্টায়।

বুধবার, ১৩ জুলাই, ২০১১

The Kalaboti Mudra

Kalaboti Mudra is a trust body organised to document folk & tribal traditional technology as this is THE vital part of our cultural history which is eroding rapidly for last two centuries or so. We do feel that most of the traditional artisan and communities are feeling the heat of the changing scenario and evicted from their age old professions with a falling income. They are majestic communities from time immemorial playing magical tri-roles as a creative genius, as a traditional engineer/keeper of indigenous knowledge and obove all marketeers of their products not only in their own backyeard, they use to sell their commodities, experteese throughout the world stage. These are the Communities who created Iron Pillar of Delhi, cave art of Ajanta-Ellora, Barbudur, AnkorVat, numerous Buddhist Hinyan-Mahayan Stupas across the world and thousands of majestic milestones & creativities. Of late new technology, new marketplace, new ethos driving them out from the competition. One can take the case of conch cell crafts persons. They possessed only shankher korat as a tool apart from three or four other. Now technology introduced drill machines, which is gaining ceremonious foothold, most of the traditional craftspersons are evaporating from the social scenario as they could not afford this and those who afford doing these job more and more rapidly and earning money opulently. And we do fear that in the next decade or so this hatiar will be at the history page and may be in the text book.

We have published some of our works at lokfolk.blogspot.com/, or buybengalihandicrafts.blogspot.com/ or kmneinitiative.blogspot.com/.
As the rapid spread of globalization and new technology and new culture in the traditional market space, the village market is shrinking rapidly for the artists and artisans of the rural Bengal. The need to spread and sustain in a new but more sustainable urban market place is a need of the hour. We are practicing a community-based business model to sell their products and disseminate their knowledge, myth, sustainable livelihood through an integrated website throughout the world in a phased manner. The profit will be ploughed back to the communities again as the communities will be in the functional in-charge of the project. Kalaboti Mudra will act as a mere facilitator just now but took vow to handed over this marketing initiative to the traditional communities in near future.
The new generations are reluctant to take communities artwork as their livelihood. This is one of our concerns. Though most of them are genius at their work. Case of Mina Dey of Shitalpati. She was 16 and left her school became one of the finest craftspersons to discover technology and art of the colourful jamdani graphics in shitalpati, even the state award winners could not even do this. The whole family(including Mina) hardly earning Rs.2000 a month by weaving this pati. We do fear that one day she could leave this majastic artwork and become house maid to earn her bread. And this new techniques will be vanished.
KalabotiMudra & LOKFOLK blog trying to encourage new generations to participate in their trade/culture and actively help them to envisage their livelihood and produces in the urban market place. we are proposing a annual scholarships for atleast 20 such young face. we ran pillers to post. no one cares. we have a list of more than 1000 such artisans across bengal.
It is a sad fact that the 4 millennium old Bengal’s folk and tribal art, knowlegebase and crafts was not rightly promoted throughout the world. This is the right time to promote the culture and arts and knowledgebase of these parts of the world. This is not a funded organization. We are doing various peripheral works like erecting theme puja pandal so that some of the community people can earn something. At the same time we are selling these authentic community creations at the market place. Believe us; various emporiums including government owned are flooded with urban fakes prepared by wealthy urban artists supported by governments. These are neither folk nor authentic tribal. The urban wealthy fake artists are eating the bread of these communities by aping their products and posing these are folk and tribal craft or art and eating their livelihood. We are encouraging the communities to undertake marketing. They are very reluctant. they will hardly survive. We have a plan in near future we will hand over both the creation and marketing job to these people who owns these crafts, technology.
thanking you